রাজশাহীর তানোরে ৪ কোটি টাকা ঘুষে ৩৫ নলকূপের ছাড়পত্র

দেশের খবর
Spread the love
Print Friendly, PDF & Email
image_pdfimage_print

মোঃ হাসান আলী স্টাফ রিপোর্টার
রাজশাহীর তানোর উপজেলায় প্রায় ৪ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে অন্তত ৩৫টি গভীর-অগভীর নলকূপে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামতে থাকায় বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে কোনো গভীর নলকূপ না বসানোর সরকারি নির্দেশনা আছে। তবে সে নির্দেশনা অমান্য করেই এসব নলকূপে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এই গুরুতর অনিয়ম করেছেন দুই কর্মকর্তা।

জানা যায়, উপজেলায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করতে হলে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন লাগে। গভীর নলকূপের অনুমোদন দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সেচ কমিটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়। সেচ কমিটির ছাড়পত্র পেলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ওই সব নলকূপের জন্য বিদ্যুৎ-সংযোগ দেয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেচ কমিটির আহ্বায়ক। আর সদস্যসচিব হলেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) স্থানীয় কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেচ কমিটির সভার কার্যবিবরণী গায়েব করে দেন তানোর থেকে সদ্য বদলি হওয়া বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। এরপর প্রায় ৩৫টি গভীর ও অগভীর নলকূপকে সভায় অনুমোদন দেওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ছাড়পত্র দিয়েছেন। বাস্তবে গত বছরের শেষ দিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সাতটি গভীর-অগভীর নলকূপকে অনুমোদন দিয়েছিল সেচ কমিটি।

সে সময় সেচ কমিটির সভাপতি ছিলেন তানোরের ইউএনও বিল্লাল হোসেন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জে কর্মরত বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমি বড়জোর সাতটি গভীর-অগভীর নলকূপের অনুমোদন দিয়েছিলাম। এখন যদি ৩৫টিতে সংযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা অবৈধ। এ রকম হওয়ার সুযোগ নেই। কীভাবে হলো তদন্ত করা দরকার।’

তানোরের বর্তমান ইউএনও ও সেচ কমিটির আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগের ইউএনও আসলেই কতটি গভীর-অগভীর নলকূপকে অনুমোদন দিয়েছিলেন, তা জানতে পারিনি। কারণ, কার্যবিবরণী খাতা থাকত কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের কাছে। খাতার জন্য আমি কামরুজ্জামানকে কয়েক দফা ফোন করেছি। তিনি আমার ফোন ধরেননি।’

ইউএনও আরও বলেন, ‘পর পর দুটি মিটিংয়ে এ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রথম মিটিংয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জহুরুল ইসলাম ছিলেন। পরের সভায় তাঁকে কাগজপত্রসহ আসতে বলেছিলাম। সে সভায় তিনি আসেননি, প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেননি। সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে বিএমডিএ কিংবা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখতে পারি। সেটা লিখব।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই তানোরে একের পর এক ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর-অগভীর নলকূপে সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি উপজেলার সবশেষ দুটি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচিত হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকে সভায় জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মোট ৪২টি গভীর-অগভীর নলকূপে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন ৩৫টি। বাকিগুলো নবায়ন ও সংযোগের শ্রেণি রূপান্তর করা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে তানোরের ইউএনও বিল্লাল হোসেন বদলি হয়ে চলে যাওয়ার পর সেচ কমিটির কার্যবিবরণী খাতা গায়েব করে দেন সদস্যসচিব ও বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। বিভিন্ন মৌজায় নতুন গভীর-অগভীর নলকূপ বসানোর অনুমোদন সেচ কমিটির আছে জানিয়ে তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ছাড়পত্র দেন। যেসব মাঠে বিএমডিএর গভীর নলকূপ আছে তার ৩ হাজার ফুট এলাকার মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর বা অগভীর নলকূপ অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অনুমোদনহীন এসব নলকূপের অনুমোদনের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মাথায় রাখেননি সহকারী প্রকৌশলী।

সেচ কমিটির সদস্যসচিব প্রতিটি গভীর নলকূপের জন্য ১৫ লাখ এবং অগভীর নলকূপের জন্য ১০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব নলকূপের জন্য ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে এভাবে প্রায় ৪ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, উপজেলা পরিষদের স্টেনো টাইপিস্ট তৌফিকুল ইসলাম এসব সমন্বয় করেছেন, আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেন ঘুষের টাকার ভাগ পেয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে পাবনায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।

বিষয়টি স্বীকার করে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘তার ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ আসার কারণে পাবনায় বদলি করা হয়েছে। অভিযোগগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। অভ্যন্তরীণ তদন্তও চলছে। তদন্ত শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে কামরুজ্জামানকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তানোর কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেনকেও ফোন করা হয়। অভিযোগের বিষয় জানালে তিনি গাড়িতে থাকার কথা বলে এড়িয়ে যান।

স্টেনো টাইপিস্ট তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার মিটিংয়ে আলোচনার দিনই আমি বিষয়টি প্রথম শুনেছি। তার আগে কিছুই জানতাম না। তাই আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *