নিজস্ব প্রতিবেদক
দুপুর ১২টা। রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকার তিনতলা একটি বাড়ি। লতানো ফুলগাছের কিছু অংশ ঘিরে রেখেছে দক্ষিণমুখী ভবনের প্রথম ফটকটি। তবে ফটকের চালার টিনগুলো আর নেই। দ্বিতীয় ফটকের কেচিগেট এখনও আছে। তবে তাতে তালা নেই। দরজা-জানালার কাঠ, গ্রিল, থাই গ্লাস কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। প্রবেশমুখের সিঁড়ির নিচে পোড়া ব্যাগ, নষ্ট জুতা, ইটের টুকরা ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।
এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক দাপুটে মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বাসভবন। একসময় এই বাসার ফটকে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকতেন। নেতাকর্মী বাসায় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িটিতে আগুন দিয়ে দরজা, জানালা এমনকি টয়লেটের কমোডও খুলে নিয়ে যায়।
বিএনপি নেতারা বলছেন, এ অবস্থার জন্য লিটনের অপকর্মই দায়ী। তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছেন। এতে দু’জন ছাত্র নিহত হন; অসংখ্য ছাত্র গুলিবিদ্ধ হন।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই পোড়া গন্ধ নাকে আসে। ইলেকট্রিক সুইচের বোর্ড, বাল্বসহ বৈদ্যুতিক কোনো কিছু চোখে পড়েনি। মেঝেতে ভেঙে যাওয়া কাচের টুকরো, বইয়ের ছাইয়ের স্তূপ। তিনতলায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে চারটি কুকুর শুয়ে আছে। বেশ কিছু বই ও কাগজ পুড়ে ছাই হয়ে আছে। বাড়ির ছাদে উঠে দেখা যায়, যেখানে পানির ট্যাঙ্কি ছিল, সেখানে কিছু নেই।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, যিনি মেয়র ছিলেন, তাঁর দোষেই এমনটা হয়েছে। কারণ, মেয়রের চেয়ারটায় বসার পর তিনি আর দলীয় নন; সবার জনপ্রতিনিধি। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দলীয় কেউ থাকেন না। আমি মেয়রের চেয়ারকে বলতাম শয়তানের চেয়ার। তাই এখানে দুই-তিন ঘণ্টার বেশি বসতাম না। কিন্তু মেয়র লিটন এখানে বসে প্রচুর অপকর্ম করেছেন। ওপরতলায় রেস্টহাউস আছে। সেখানে দেড় মাস ধরে অস্ত্রধারীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। গত ৫ আগস্ট বাড়িটিতে হামলার আগে লিটনের নেতৃত্বে অস্ত্রধারীরা দু’জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। এতে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর ভুলের কারণেই এসব হয়েছে।
লিটন কোথায়?
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগমুহূর্তে রাজশাহীর আলুপট্টিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। ওই দিন বিকেলেই নগর ভবন ও তাঁর নিজস্ব বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ আগেই লিটন সপরিবারে আত্মগোপনে চলে যান। তিনি কোথায় আছেন– এ নিয়ে সেদিন থেকেই চলছে গুঞ্জন। কেউ বলছেন, ভারতে পালিয়ে গেছেন। কেউ বলছেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন।
সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট দুপুর থেকে রাজশাহীর আলুপট্টি এলাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্র-জনতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ দলীয় নেতারা। অপর পক্ষে ছাত্ররা তালাইমারী থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন আলুপট্টির দিকে। আলুপট্টিতে দু’পক্ষ মুখোমুখি হলে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা সংঘর্ষ চলে। এ সময় গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারা যান রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী আলী রায়হান ও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব আনজুম।
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট বিকেলে খায়রুজ্জামান লিটন তাঁর বাড়িতে আক্রমণ হতে পারে– এমন খবর পান মাত্র কয়েক মিনিট আগে। তখনই তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা ও জামাতাকে নিয়ে গাড়িতে বেরিয়ে যান। পরিবার নিয়ে প্রথমে আশ্রয় নেন সেনানিবাসে। এর পরই উপশহরে তাঁর ফাঁকা গাড়ি দেখতে পেয়ে জনতা তাতেও হামলা চালায়। পরে গাড়িটি এনে রাখা হয় নগর ভবনের গ্যারেজে।
আওয়ামী লীগের এক নেতার দাবি, খায়রুজ্জামান লিটন ৫ আগস্ট রাতেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। বর্তমানে তিনি দিল্লিতে অবস্থান করছেন। শিক্ষার্থী আলী রায়হান হত্যার ঘটনায় গত ২০ আগস্ট বোয়ালিয়া থানায় মামলা হয়। এতে প্রধান আসামি করা হয় এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে। ২৩ আগস্ট সাকিব আনজুম হত্যা মামলায় খায়রুজ্জামান লিটনকে ৪২ নম্বর আসামি করা হয়