মোঃ হালিম কাজী স্টাফ রিপোর্ট
ঈদ উপলক্ষে দুস্থদের জন্য রাজশাহীতে বরাদ্দকৃত বিশেষ ভিজিএফ কার্ডে ভাগ বসিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। রাজশাহীর ৭২টি ইউনিয়ন ও ১৪টি পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে ১ লাখ ২২ হাজার বিশেষ ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রতিটি কার্ডধারী দুঃস্থ ও অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা। গত শনিবার থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে কার্ড ও চাল বিতরণ শুরু হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগে বলছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলীয় লোকদের নামে কার্ডের তালিকা করে জমা দিয়েছেন। ফলে প্রকৃত দুস্থরা বিশেষ এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জানা গেছে, রাজশাহীর কোনো কোনো ইউনিয়ন ও পৌরসভার জন্য বরাদ্দকৃত কার্ডের অর্ধেক আবার কোথাও চারভাগের তিন ভাগই নিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এলাকার সংসদ সদস্য ও প্রশাসন থেকে চাপ দিয়ে দলীয় কোটা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক জনপ্রতিনিধি।
দলীয় চাপে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। বঞ্চিত দুস্থদের পাশাপাশি ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মাঝেও।
রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বিশেষ সহায়তা ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে পৃথক কমিটি রয়েছে। পদাধিকার বলে উপজেলা ত্রাণ কমিটির উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ত্রাণ কমিটির সভাপতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব। তবে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব রয়েছে ওয়ার্ড সদস্য ও পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ওপর কিন্তু তারা স্বাধীনভাবে কার্ডের তালিকা করতে পারছেন না। দলীয় নেতারা নিজেদের করা দুস্থ কার্ডের তালিকা করে ওয়ার্ড সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলদের স্বাক্ষর করতে বাধ্য করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের একটি বড় অংশই দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে গেছে।
রাজশাহীর মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান জানান, আমার পৌরসভায় এবার বিশেষ ভিজিএফ কার্ড এসেছে ৩ হাজার ৮১টি। এর মধ্যে দলীয় নেতারা ১ হাজার কার্ডের তালিকা আগেই দিয়ে রেখেছেন। সে অনুযায়ী আমরা চাল বিতরণ করেছি। বেশ কয়েক বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। সব বরাদ্দেই দলীয় কোটা থাকে। দুস্থদের চালের কার্ডেও আছে।
অন্যদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে ৬ হাজার ৪০০ বিশেষ ভিজিএফ কার্ড এসেছে। এর মধ্যে এলাকার সংসদ সদস্যের মৌখিক নির্দেশে ২ হাজার ৩০০ কার্ড দলীয় লোকদের দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা দলীয়ভাবে কার্ডের তালিকা তৈরি করে পৌর মেয়রের কাছে জমা দিয়েছেন।
গোদাগাড়ী পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ওয়ার্ডে ৩৫০টি কার্ড বরাদ্দ হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে দেওয়া হয়েছে ১২৪টি। বাকি ১২৬টি কার্ডের দলীয় তালিকা জমা দিয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের দলীয় নেতারা। এই জনপ্রতিনিধি বলেন, কার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদেরই স্বাক্ষর দিতে হচ্ছে। অথচ আমরা জানি না দলের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা প্রকৃতই দুস্থ কিনা।
গোদাগাড়ী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম জানান, পৌরসভার ৪ হাজার ৬০০ কার্ডের মধ্যে অর্ধেক দলীয় কোটায় দেওয়া হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৩০০ কার্ডের মধ্যে মেয়র নিয়েছেন ৪৫০টি। বাকি ১ হাজার ৮৫০ কার্ড সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রতিটিতেই দুস্থদের চালে ভাগ বসিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার জন্য ঈদ উপলক্ষে ৩ হাজার ৮০টি বিশেষ ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ আসে। এর মধ্যে ৪৫০টি কার্ড দলীয় নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আড়ানী পৌরসভার মেয়র মুক্তার হোসেন।
এদিকে রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ পৌরসভায় ঈদ উপলক্ষে ৪ হাজার ৬০০টি বিশেষ ভিজিএফ বরাদ্দ হয়।
ভবানীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আব্দুল মালেক বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের হয়ে কতিপয় দলীয় নেতা কিছু কার্ড দাবি করেছিলেন; কিন্তু আমি নিজেই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমি দলীয় কোটায় কোনো কার্ড দেইনি। ওয়ার্ড কাউন্সিলররাই প্রকৃত দুস্থদের তালিকা করে চাল বিতরণ করেছেন।
দুস্থদের চালে দলের ভাগ বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ দুস্থ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি কার্ডের বিপরীতে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিধি-বিধান অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিরা প্রকৃত দুস্থদের তালিকা করে চাল বিতরণ করবেন-এমন নির্দেশ দেওয়া আছে। দলীয় কোনো কোটার কথা সরকারি নির্দেশনানামায় নেই।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা ত্রাণ-পুনর্বাসন কমিটির সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, এসব বিশেষ বরাদ্দ প্রকৃত দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য। দলীয় কোনো কোটার সংস্থান নেই। কেউ এমনটা করলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।