বিশেষ প্রতিনিধি,দৈনিক আমাদের জন্মভূমি।।
মরিয়ম আফনান (রাহা ইসলাম)। আসছে সতেরো আগষ্ট বারো বছর পূর্ণ হতে যাওয়া মেয়েটা জীবনের এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, যে বাস্তবতাকে কল্পনা করতেও রীতিমতো গা শিউরে উঠবে যেকোনো পরিনত বয়সী কঠিন হৃদয়ের মানুষেরও।আরও কি কি অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলোতে তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন।আসুন জেনে নিই কে এই রাহা,আর কি ঘটেছে ওঁর সাথে?
> ১২ জুন থেকে নিখোঁজ ছিলো সাংবাদিক কন্যা মরিয়ম আফনান রাহা।
> ১৪ জুন দিবাগত রাত দেড়টার সময় রাহার বাবার ফোনে কল আসে ভারতীয় নম্বর থেকে।কল রিসিভ করলে ঐ প্রান্ত থেকে বাংলায় জিজ্ঞেস করা হয়,মরিয়ম আফনান রাহা আপনার কি হয়?
তিনি বলেন আমার মেয়ে,কোথায় আমার মেয়ে?
উত্তর আসে,আপনার মেয়ে এখন আমাদের কাছে আছে।সে অনেক বুদ্ধিমতী ও সৌভাগ্যবতী।আর তাই আপনার মেয়ে ভয়ানক বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছে।নিজেকে আসাম বনগাইগাও রেলওয়ে থানার এএসআই পরিচয় দিয়ে তিনি জানান,আমরা চারজন রুটিন ডিউটিতে ছিলাম। প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন এসে থামতেই হঠাৎ একটি মেয়ে দৌড়ে এসে আমার পায়ে ধরে বলে,আঙ্কেল আমাকে বাঁচান।আমাকে ওঁরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে,এখন কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে।আমরা সেই বগিতে গিয়ে দুটো ছেলেকে পালাতে দেখি আর একটি মেয়েকে উদ্ধার করি। আপনার মেয়ে নারী পাচারকারী চক্রের কবল থেকে সাহসিকতা ও বুদ্ধির জন্য বেঁচে গেছে।রাহার উৎকন্ঠিত বাবা সেই এএসআইকে অনুরোধ করে বলেন, দয়াকরে আমার মেয়েকে আপনাদের হেফাজতে রাখবেন।আমি ছাড়া অন্য কারো নিকট ওকে হস্তান্তর করবেন না।এএসআই তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন,আমরা এখন আপনার মেয়ে ও অন্য মেয়েটিকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নিবেন আর আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন
পরিবার ও স্থানীয় প্রশাসন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।অন্ততঃ বেঁচে তো আছে রাহা!পরদিন রাহার বাবা স্থানীয় সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ও সবকিছু থানাকে অবহিত করেন।বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সদর থানার একজন কর্মকর্তা ভিডিও কলে আসাম পুলিশের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হন।
সন্ধ্যায় আসাম বনগাইগাও থানার ইনচার্জ পরিচয় দিয়ে একজন রাহার বাবাকে বলেন,আপনি দ্রুততম সময়ের ভেতর এখানে আসুন।মেয়েকে নিয়ে যান।এই নম্বরটি সেভ করে নিন।যাবতীয় যোগাযোগ করতে আপনি এই নম্বরে কল দিবেন।তখন ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে, তারউপর রাহার বাবার পাসপোর্ট নেই, আর্থিক সামর্থও নেই বলে জানান সেই কর্মকর্তাকে।তিনি বলেন,আপনাকে যেভাবেই হোক এখানে আসতে হবে।আসামের সেই কর্মকর্তাকে যথেষ্ট মানবিক বলেই মনে হয়েছে রাহার বাবার নিকট।উনি রাহাকে সুযোগ পেলেই তাঁর বাবার সাথে কথা বলার সুযোগ করো দিয়েছেন।
চারদিন থানা হাজতে ছিলো রাহা।চারদিনই সেই মানবিক পুলিশ ইনচার্জ সুযোগ দিয়েছেন বাবার সাথে কথা বলার।
রাহা সবসময় বাবাকে বলেছে,পাপা আমার অনেক ভয় লাগে, তুমি আমাকে নিয়ে যাও।
সবশেষ গত ১৯ জানুয়ারী সেই কর্মকর্তা রাহার বাবাকে বলেন,আপনার মেয়েকে আজকের পর আর দিতে পারবোনা (কথা বলতে)।সে এখন কোর্টে আছে, আদালত তাঁকে সেফহোমে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
আপনাকে আবারও বলছি,আপনি আসুন।আমরা রাহার মেডিকেল টেস্ট করিয়েছি,সে মানসিকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে বলে জানা গেছে।আপনি যদি আসেন,আমাকে কল দিবেন।আমি আপনাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিবো,আশাকরি সেইদিনই মেয়ে মুক্ত হয়ে যাবে।
তাঁদের নিকট পাসপোর্ট না থাকায় দুই মেয়ের বিরুদ্ধেই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করার মামলা দেওয়া হয়েছে।তখন রাহার বাবা প্রশ্ন করেন, আমার মেয়ের তো অপরাধ নেই, সে ইচ্ছে করে আপনার দেশে যায়নি।তবুও তাঁকে মামলায় জড়িয়ে দিলেন? উত্তরে তিনি বলেন,আপনার মেয়েটা যেনো দ্রুত আপনার কাছে যেতে পারে সেই ভাবনা থেকেই আমি এটা করেছি।কেননা কোন মামলা হলে সেটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সে ভারত ছাড়তে পারবেনা।(আরও কিছু কথা বলেন তিনি,যা প্রকাশ করা সমীচীন
হবেনা বলে উল্লেখ করা হলোনা)
ঐদিন তিন মিনিট মেয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ পান তিনি।
মেয়ে তাঁকে “ভয় লাগে,আমাকে নিয়ে যাও ” বললে তিনি মেয়েকে সহসাই আসবেন বলেন।মেয়ে জানায় আমাকে অনেক দুরে নিয়ে যাবে।চার ঘন্টা না-কি লাগে সেখানে যেতে।পরে রাহার বাবা জানতে পারেন,গুয়াহাটি সেফ হোমে রাখা হবে তাঁর মেয়েকে।
মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে টাকা,সময় ও ভিসা প্রাপ্তীর জটিলতার কাছে অসহায় বাবা বিভিন্ন জায়গায় সাহায্যের জন্য যান।জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার,গুয়াহাটিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাবতীয় পেপারস জমা দিয়ে মেয়েকে ফিরে পেতে রাষ্ট্রের সহযোগিতা চান।জেলা প্রশাসক মহোদয় (ওঁর বাবার ভাষায়)চিঠি পেতেই পুলিশ সুপার, দু’জন ম্যাজিষ্ট্র্যাট(এডিসি ক্ষমতাধারী)দের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।এবং জেলার এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে করণীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।
কোন কারণে সেইদিন তিনি মোবাইল বন্ধ করে রেখে ঢাকায় হেনপেনতেন মিডিয়ার অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন।কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসবেন, অমন সময় দেশ টিভি থেকে কল দিয়ে সম্ভব হলে তাঁদের অফিসে যাবার কথা বলেন একজন সাংবাদিক। ত্বরিত তিনি সেখানে যান।তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করা হয়।
রাহার পিতা স্থানীয় মহলে একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে সুবিদিত।নারায়ণগঞ্জের এক বিশিষ্ট সূধীজন সেদিন রাতেই চাষাঢ়া শহীদ মিনারে তাঁকে বিমর্ষ মুখে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে বসেন,কোথায় তোমার সাংবাদিক সমাজ?এমন ভয়ানক বিপদে কেউ কেনো তোমার পাশে দাঁড়াচ্ছে না?
আজ ছোট্ট মেয়েটাকে যখন টাকার জন্য ভিনদেশে সীমাহীন যন্ত্রণায় বন্দীত্ব মেনে নিতে হচ্ছে,তখন কিছু প্রশ্ন সামনে এসেই যায়।
প্রথমতঃ আমাদের সীমান্ত এতোটাই অরক্ষিত যে,মাত্র কয়েক ঘন্টায় পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া রাহাকে নিয়ে পাচারকারীরা সহজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেলো?
চোরাই পথে ভারতে যাতায়াত নতুন ঘটনা নয়।
কিন্তু সেগুলো দালালের মাধ্যমে সুবিধাজনক সময়ে পারাপার হয়ে থাকে। তা বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়।
কিন্তু রাহা পাচার ঘটনায় সীমান্তে “ডাল ম্যায় কুচ কালা হয়ায়” বলেই প্রমান হয়।
দ্বিতীয়তঃ আর কতো নারী পাচারের শিকার হবে?আমাদের প্রশাসন কি বিষয়টিকে গতানুগতিক ধারাতেই আটকে রাখবেন?কেনো রাষ্ট্র মানবপাচারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবেনা?
তৃতীয়তঃ রাহার কি অপরাধ? সে কি ইচ্ছাকৃত সেখানে গিয়েছে? না তো?রাহার পিতা গুয়াহাটি বাংলাদেশ হাইকমিশনে ঘটনা জানান ১৯ জুন। তাঁর নিকট ডকুমেন্টস চাওয়া হলে তিনি তাৎক্ষণিক তা পাঠান।হাইকমিশন কি একটু আন্তরিক হতে পারতোনা?
বারো বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে।তাঁর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভীষিকার কথা ভেবে ভারতীয় পুলিশের মায়া হলো,আর আমাদের শীর্ষ মিডিয়ার মায়া হলোনা?অথচ কানাডা থেকে দেশে এসে রগরগে ইতিহাসের পর দুই স্বামীর একজনকে খুন করে আবার কানাডায় ফিরে যাওয়া পারভীন অবিশ্বাস্য ভাবে গতকাল
২৯ জুন সহ মোট পাঁচবার সংবাদ হয়ে আসে!শীর্ষ মিডিয়াগুলো রীতিমতো মানবতার সংগা নতুনভাবে আবিষ্কার করতে চলেছেন!
সাংবাদিক সমাজ অন্ধকারের বিরুদ্ধে লিখেন।আর বাস্তবতা হচ্ছে
তাঁরা নিজেরাই মানসিকতার দিক থেকে অন্ধকারে ডুবে আছেন।
তেঁতো হলেও এটি শতভাগ সঠিক।
সর্বশেষ:- গত ২৪ জুন দেশ টিভির সংবাদে বিষয়টি জেনে রাজশাহীর দৈনিক আমাদের জন্মভূমি ও রাজশাহীর সাংবাদিক সমাজ ৩০ জুন রবিবার রাহাকে ফিরিয়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনায় মানব বন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করলেও রাহার পিতার অনুরোধে মানববন্ধন না করে দোয়া মাহফিল করার অনুরোধ করলে সন্ধ্যায় দেড়শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।অন্যদিকে
বরেণ্য সম্পাদক ও লেখক মুস্তাফিজ শফির নির্দেশে প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক জনাব রাজু বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বলে জানিয়েছেন মরিয়ম আফনান রাহার পিতা।