রাজশাহী কেন এত সুন্দর?

Spread the love
Print Friendly, PDF & Email
image_pdfimage_print

মোঃহালিম কাজী রাজশাহী স্টাফ রিপোর্টার

পরীর শহর বলে একটা কথা আছে। বিশ্বের অনেক শহরকে পরীর শহর বলা হয়। রাজশাহী শহরও কি তাই হতে যাচ্ছে?

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী রাজশাহী। দৃষ্টিনন্দন এই শহরটির রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে লাগানো বিভিন্ন ধরনের লাইট। রাতের বেলা এই লাইটিংয়ের আলো-আধারির খেলায় বিমোহিত হবেন যে কেউ। এছাড়া রাস্তার মাঝখান দিয়ে লাগানো সারি সারি সবুজ গাছ, যা দেখলেই মনে হবে যেন সবুজ শীতল কোনো গ্রামের মেঠোপথ। রাজশাহীর এই উন্নয়ন একেবারে কম সময়েই সম্ভব হয়নি। এর জন্য ছিল কাজের দীর্ঘ পরিকল্পনা ও সঠিক বাস্তবায়ন। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এসব উন্নয়নের দাবিদার। কারণ এই সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র যেভাবে রাজশাহীর উন্নয়ন করেছেন, দলমত নির্বিশেষে যে কেউ এই উন্নয়নের প্রশংসা করবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর রোববার (২৯ জানুয়ারি) রাজশাহী সফর করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এ আগমন উপলক্ষে রাজশাহীতে যেন লেগেছে উৎসবের রং। নগরীর বর্ণিল সাজ, সাধারণ মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা; এ যেন পুরোনো রাজশাহীর নতুন রূপ। সফরে তিনি ২৬টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন এবং ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মোট ৩২টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজশাহীর চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যাবে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

রাজশাহীর উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গত ১৪ বছরে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি করেছি। একটু আগেই আমরা প্রায় ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন করেছি। এর মধ্যে ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, এ রাজশাহীতে জাতির পিতা স্বাধীনতার পর কলকারখানা করে দেন। এরপর সব বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ বন্ধ কারখানা চালু করতে কাজ করে। পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য দীর্ঘ বাঁধ করে দিয়ে সেই ভাঙন আমরা রোধ করে দেই। এ রাজশাহীর মানুষের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এরইমধ্যে রাজশাহীর মানুষের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা

উত্তরবঙ্গের অন্যতম এই বড় শহর অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী। তাইতো বিশ্ব দরবারে গ্রিন সিটি হিসেবে রাজশাহী পরিচিত হয়েছে অনেক আগেই। এরইমধ্যে ইউনেস্কো ঘোষিত পরিচ্ছন্ন ও সবুজ নগরী হিসেবে স্বীকৃত রাজশাহী। হযরত শাহ মাখদুমের স্মৃতি বিজড়িত শহর রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন পদ্মা নদী। পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট পার্ক-রিসোর্ট। জোসনা ও লাইটিংয়ের আলো-আধারিতে নদীর বুকে চলে অন্য রকম এক খেলা। নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের সঙ্গে লাইটিং- এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি।

সবুজ নগরায়নে অনন্য দৃষ্টান্ত রাজশাহী। সবকিছুকে ছাপিয়ে রাজশাহী যেন ছুটে চলছে পরীর শহরের লক্ষ্যপানে। এই সুন্দরের পেছনের কাহিনী কী? কেন রাজশাহী এত সুন্দর? কিভাবে হলো রাজশাহীর এই উন্নয়ন? এসব প্রশ্ন শুধু রাজশাহীবাসীর নয়, এ প্রশ্ন বহু মানুষের।

রাজশাহীর উন্নয়ন নিয়ে শহরের ভদ্রা মোড়ের বিশিষ্ট ফল ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ‘রাজশাহী যতটা সুন্দর, ততটাই সুন্দর এখানকার মানুষ। কেননা, মানুষ সুন্দর না হলে পরিবেশ সুন্দর থাকে না। তবে আমাদের এই রাজশাহীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মেয়র সাহেবের (খায়রুজ্জামান লিটন) ভূমিকা অনেক। তিনি বেশ সৌখিন মানুষ। তার নিজেরই রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে ভালো লাগে। এ জন্যই তিনি এই শহরকেও সুন্দর করে সাজিয়েছেন।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাহি আবদুল্লাহ সময় সংবাদকে বলেন, আমার কাছে মনে হয় ভাষার কারণে রাজশাহী সুন্দর। রাজশাহীর ভাষা খুব সুন্দর। এছাড়া এখানকার জীবনযাত্রার মানও সুন্দর। কম খরচে এখানে জীবনযাপন করা যায়। যানবাহন ভাড়া তুলনামূলক অনেক কম।
১৪ বছরে রাজশাহীতে উন্নয়ন ব্যয় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা

রাজশাহীর সৌন্দর্যের নেপথ্যের কথা জিজ্ঞেস করলে রাহি বলেন, রাজশাহীর সৌন্দর্য ও উন্নয়নের মূল মানুষটা হলো মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ভাই। তিনি পুরো রাজশাহীর আশীর্বাদ। তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অপরূপ সৌন্দর্য রাজশাহীর কারিগর।

এক যুগ আগের রাজশাহীর সঙ্গে এক যুগ পরের রাজশাহীর পার্থক্যের কথা জিজ্ঞেস করলে রানী বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা মাসুম শাহরিয়ার সময় সংবাদকে বলেন, আগের চেয়ে এখন রাজশাহী শহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা অনেক প্রশস্ত হয়েছে, বেড়েছে আলোকসজ্জা। এবং রাস্তার পাশে দৃষ্টিনন্দনের জন্য গাছ লাগানো হয়েছে। আগের থেকে পরিচ্ছন্নতার জায়গাটাও বেড়েছে। রাস্তা ঝাড়ু দিতে প্রতিদিন রাতেই লোক আসে। এছাড়াও প্রতিটি দোকানের সামনে বিন দেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকেও লোক রাস্তা পরিষ্কার করতে আসে।

তবে খারাপ লাগার কিছু বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজশাহীর ঐতিহ্যগত দিক থেকে কিছু স্থাপনা ছিল। যেমন: রানিবাজার, ঘোড়ামারা, বাটারমোড় এলাকায়। এখন সেসব এলাকার সেই পুরোনো কারুকাজের বাড়িগুলো নেই। এতে রাজশাহী তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। উন্নয়নের প্রয়োজন আছে তবে ঐতিহ্যের বিষয়টিও ভাবা উচিত।

রাজশাহীর সৌন্দর্য নিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন সময় সংবাদকে বলেন, এই শহরকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়া আমাদেরকে ধরে রাখতে হয়েছে। শহরের এই পরিচ্ছন্নতা ও সবুজায়ন তো একদিনে হয় না। এগুলো করতে আমাকে অনেক পদ্ধতি বের করতে হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখন এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। মানুষজন বলছেন যে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বসবাসযোগ্য নগরী রাজশাহী। এটা শুনলে আমার খুব ভালো লাগে

রাজশাহীর বিশিষ্টজনরা বলছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজে মোড়ানো এই শহরের সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিকল্পিত নগরায়ন ও বৃক্ষরোপণ। এছাড়া নগর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জিরো সয়েল প্রকল্প গ্রহণ অন্যতম। সিটি করপোরেশনের দক্ষ কর্মী ও চৌকস পরিচালনায় শহরের যেকোনো ময়লা-আবর্জনা নিমিষেই পরিষ্কার করা হয়। শহরের অভ্যন্তরে কোথাও ময়লা আবর্জনার স্তূপ সাধারণত চোখে পড়ে না। কোথাও দেখা গেলেও তা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয়। যার ফলে এই ময়লা-আবর্জনা শহরের বাতাসকে দূষিত করতে পারে না।

রাজশাহী: সৌন্দর্য ও উন্নয়নে বদলে যাওয়া এক স্বপ্নীল নগরী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর পুরনজিত মহালদার সময় সংবাদকে বলেন, বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক ও ছাত্র হিসেবে রাজশাহীকে দীর্ঘদিন ধরে দেখছি। ২২ থেকে ২৩ বছর আগে রাজশাহীতে এসেছি। তখনকার রাজশাহী আর বর্তমানের রাজশাহী আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বর্তমান রাজশাহীকে আমরা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, পুরো বিশ্বের একটা রোল মডেল শহর হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান রাজশাহীর সৌন্দর্য ও পরিবেশ এবং ইতিবাচক দিকগুলো ও পরিকল্পিত নগরায়ন ব্যবস্থাপনায় যারা কাজ করছেন, শিক্ষক হিসেবে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।

রাস্তাঘাটের উন্নয়ন রাজশাহী শহরকে করেছে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত। শহরে নামলেই দেখা মিলবে প্রধান সড়ক বিভাজক দিয়ে লাগানো সারি সারি দৃষ্টিনন্দন গাছ। এর ভেতর লাগানো হয়েছে রঙ্গন, কাঠ করবি, চেরি ও এ্যালামুন্ডা। সব নিচে লাগানো হয়েছে সবুজ হেজ। এরপর কাঠ ও বাঁশের আদলে তৈরি করা হয়েছে কনক্রিটের বেড়া। এছাড়া নগরীর এই সৌন্দর্য ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবৈধ পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন। অন্যদিকে নগরীর ফুটপাতের ওপর সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ করেছে রাসিক। সব মিলিয়ে এক দৃষ্টিনন্দন নগরী হয়ে উঠেছে রাজশাহী।

রাজশাহীর সৌন্দর্য নিয়ে কেউ প্রশংসা করলে কেমন অনূভুতি হয় এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র লিটন বলেন, সরকারি পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অথবা দেশের বাইরের কোনো নাগরিক যদি রাজশাহীতে আসেন এবং এই শহর সম্পর্কে খুব ইতিবাচক মন্তব্য করেন, তখন আমার খুবই ভালো লাগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *