১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই মাসব্যাপী বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা।’ ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা।
বইমেলায় কিছু পরিবর্তন ঘটে প্রতি বারই। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বরং বইমেলার চিরচেনা যে দৃশ্যপট, নানারকম বিড়ম্বনা আর ঘেঁষাঘেঁষি করে বই কেনার যে পরিবেশ চোখে ভেসে ওঠে, এবার সে চিত্র দেখা যাবে না বলেই মনে হচ্ছে। বিড়ম্বনামুক্তভাবে বইপ্রেমীরা যেন বই কিনতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে পারেন সেসব বিষয় মাথায় নিয়েই বইমেলা চত্বর নতুনরুপে সাজিয়েছে বাংলা একাডেমি এনেছে। এতে স্বস্তি পাবেন পাঠক, দর্শনার্থী, লেখক ও প্রকাশক। বইমেলার দুয়ার খোলার আগে মেলার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, এবার মেলায় ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৮৯৫টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮৬টি সাধারণ স্টল এবং ১০৯টি স্টল লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। তাছাড়া এ বছর মোট ৩৭টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গত বছর ৬০১টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ড. মুজাহিদ জানান, এ বছর মেলার পুরো কাজ বাংলা একাডেমি একাই করছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মাসব্যাপী সেমিনারের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি আঁকা, সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকছে।
আয়োজকরা জানান, গত ২৩ জানুয়ারি ডিজিটালাইজড লটারি পদ্ধতির মাধ্যমে পুরানো এবং নতুন তালিকাভুক্ত প্রকাশনার জন্য স্টল বরাদ্দ করা হয়। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত ৬০১টি সংস্থা ছাড়াও, প্রায় ৭০টি নতুন প্রকাশনা নোটিশে সাড়া দিয়ে স্টল বরাদ্দ পেতে আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ২৩টি নতুন প্রকাশনা মেলায় অংশ নেয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে মেলা শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয় পরবর্তী মেলার প্রস্তুতি এবং প্রস্তুতি পর্বের জন্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য এবং মাসব্যাপী মেলা পরিচালনায় তিন ধাপে পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে এবারের শুরু হওয়া বই মেলায়।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি এবং অনুষ্ঠান হিসেবে বইমেলাÑ উভয়েই বাঙালির তাৎপর্যময় জাতীয় ঘটনা একুশে ফেব্রুয়ারির স্মারক হয়ে রয়েছে। জাতীয় অনুষ্ঠান হিসেবে একাডেমি আয়োজিত বইমেলার আবেদন একেবারেই অন্যরকম। এদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে প্রকাশনার সংখ্যা ও বই বিক্রির আর্থিক যোগফল। তবে বইমেলার নানান সীমাবদ্ধতার কথাও ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশনা-প্রযুক্তি সহজ ও উন্নত হওয়ায় বছর বছর বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু মান সার্বিকভাবে বাড়ছে না। ভালো-মন্দের সংমিশ্রণে মানসম্পন্ন গ্রন্থ বেছে নিতে পাঠককে রীতিমতো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। আজকাল মননশীল ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থের প্রতি পাঠকের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু চাহিদামাফিক সঠিক গ্রন্থটি খুঁজে পেতে পাঠককেও গবেষকের ভূমিকা নিতে হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মূল মেলা স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে অপরিকল্পিত স্টলবিন্যাসের কারণে বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়েছে। মেলায় প্রবেশ করার পর একদিক দিয়ে পরিভ্রমণ করলে, অন্যদিকের স্টলগুলো বাদ পড়ে যায়। অনাদরে রয়েছে শিশুদের উপযোগী গ্রন্থ, অথচ সেখানেই প্রকাশকদের অধিক মনোযোগ ও যত্ন নেওয়ার কথা। শিশুদের গ্রন্থের সব সময় চাহিদা থাকায় কতিপয় লেখক-প্রকাশক ভুল বানানে, নিম্নমানের ছাপায়, অনাকর্ষণীয় উপস্থাপনায় অশিক্ষণীয়, অদ্ভুত কিংবা ভূতের বই প্রকাশ করছেন। সম্পাদনা ছাড়া গ্রন্থ প্রকাশ মানসম্পন্ন প্রকাশকের দিক থেকে লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত।
লেখক-প্রকাশকের দিক থেকে কৌতূহলোদ্দীপক ও বিষয়-আঙ্গিকে আকর্ষণীয় বই উপহার দেওয়ার উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সরকারের মোটা অঙ্কের তহবিল হতে প্রতি বছর যেসব গ্রন্থ কেনা হয়, তাতেও রাজনৈতিক বিবেচনা থাকে। তা মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশকদের হতাশ করে তোলে। ভাষার মাসে সংশ্লিষ্ট সবার ভাবনা ও উদ্যোগে গুণগত পরিবর্তন আসবেÑ এটাই প্রত্যাশা।