জন্মভূমি নিউজ ডেস্ক
শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতন, হয়রানি, বুলিংয়ের মতো অনভিপ্রেত ও অনৈতিক কাণ্ডে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই মুখ খোলেন না। যারা সাহস করে অভিযোগ জানান, শুরুতেই তারা সমাধান পাচ্ছেন না। সমাজে যে নৈতিক স্খলন ঘটছে দিনের পর দিন, এর বহির্প্রকাশ ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানিসহ একের পর এক অপ্রীতিকর কাণ্ডে মাধ্যমে। এসব কাণ্ড প্রতিকারে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি আছে, সেটিও কার্যকর নয়।
অন্যদিকে ভুক্তভোগীর সুরক্ষা নেই। উপরন্তু কেউ অভিযোগ করার পর নিপীড়নের মাত্রা বরং আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণেই পরবর্তীকালে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। এগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শঙ্কিত করে তুলছে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আত্মঘাতী শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার হয়রানির অভিযোগ গুরুত্বই দেয়নি প্রক্টর অফিস। নিজের বিভাগও অভিযোগের দায় সেরেছে শুধু সুপারিশ করে। তাই অভিযোগ করার পর নানা রকম নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নিপীড়নের বিষয়টি জানিয়ে আরও বেশি মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অবন্তিকাকে। পর্যায়ক্রমে চরম হতাশায় নিমজ্জিত অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নেন। অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।
এর আগে ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির দায়ে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই শিক্ষার্থী প্রথমে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। এর পর তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেন শিক্ষক সাজন সাহার বিরুদ্ধে। এর আগে তার অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওই বিভাগেরই এক নারী শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ওই অধ্যাপকের অফিসকক্ষে তালা দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ফলে ওই শিক্ষককে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ আবাসিক হলে ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে কৌশলে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ছাত্ররাজনীতিতে নেতার পদধারী এক শিক্ষার্থী এবং তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন পুরুষ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকের বরখাস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একই স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে। সে ঘটনায় ওই শিক্ষককে ক্লাস থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
এভাবে শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক যৌন নির্যাতন, হয়রানি, বুলিংয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, নিজেও শিক্ষক হিসেবে এ ধরনের ঘটনায় আমি বিব্রত। সামাজিক-নৈতিক স্খল ঘটছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর বহির্প্রকাশ হচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়ের এসব ঘটনা। এসব প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনে যোগ্যদের পদায়ন হয়নি বলে মনে করেন তিনি। এমনকি কোনো ঘটনায় যখন একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, শুরুতেই যদি এর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা হলে অনেক অভিযোগ অঙ্কুরেই সমাধান হয়ে যায়। বড় দুর্ঘটনা দেখতে হয় না, এত হইচই হয় না। এ জন্য প্রতিটি অভিযোগ শুরুতেই গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।
শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয়, যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই হোক- অপরাধ সর্বত্রই অপরাধ। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে শুরুতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে এর প্রতিকার অনেকাংশে বেড়ে যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন শাহারিয়া আফরিন। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় অভিযোগ দিতে পারাটাই একজন নারীর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের যে আইন-বিধি-নীতি রয়েছে, এগুলোতে ভুক্তভোগীর পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই। আমরা দেখছি, যখন একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ দিচ্ছেন, তখন তার প্রতি দ্বিগুণ নিপীড়ন শুরু হয়। সেটি সামাজিক, মানসিক, এমনকি শারীরিকও হয়ে থাকে। নারীর যতই ক্ষমতায়ন করা হোক, আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক। এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। পরিবার থেকেই নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, নারীকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা শুরু করতে হবে।
তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, কখনো-বা বিচারহীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। একজন যখন অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, আরেকজন একই ধরনের অপরাধ করতে কোনো দ্বিধা করেন না (সাইকোলজিক্যালি)। মনে করেন, এতে কোনো শাস্তি হবে না।
যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি আছে জানিয়ে এ প্রসঙ্গে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এ সংক্রান্ত সেল আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব সেলে খুব একটা অভিযোগ পড়ে না। মেয়েরা হয়রানির শিকার হলেও তা সহজে সামনে আনতে চায় না। আবার অনেকভাবেই তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। যদি বিশ^বিদ্যালয়গুলো এমন একটা ভাবমূর্তি দাঁড় করাতে পারে যে, সব অভিযোগের ক্ষেত্রেই জিরো টলারেন্স; তা হলে হয়তো অনেকে অভিযোগ দিতে সাহসী হবেন।
উল্লেখ্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আলীম ‘বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২০০ ছাত্রীর সাক্ষাৎকার নেন। গবেষণার ফলে বলা হয়, ৫৬ শতাংশ নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। ১০ শতাংশ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি ৫ শতাংশ সেলে। ৯০ শতাংশ জানান, ন্যিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।