বেপরোয়া ছিনতাই, একের পর এক ঝরছে প্রাণ

দেশের খবর
Spread the love
Print Friendly, PDF & Email
image_pdfimage_print

জন্মভূমি নিউজ ডেস্ক :
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এক সপ্তাহে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে উত্তেজিত লোকজন পিটিয়ে মেরেছে তিনজনকে। গত ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক কাটছে না। দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

গত বছর রাজধানীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এক দন্ত চিকিৎসক ও এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত বছরের ৭ অক্টোবর এক আদেশে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ‘ছিনতাই প্রতিরোধ টাস্কফোর্স’ গঠন করে। এর পর থেকে দীর্ঘদিন ছিনতাই কিছুটা কম হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাই ও ডাকাত চক্রের সদস্যরা।

গত ১৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘রাজধানীতে ছিনতাই বেড়ে গেছে। ছিনতাই রোধে শেষ রাতে পুলিশের টহল বাড়াতে হবে। শেষ রাতের দিকে পুলিশ যখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, তখন ছিনতাই হয়। এ জন্য রাতে পুলিশের টহল বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলিতেও মানুষ ছিনতাই ও ডাকাতির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর ও উত্তরা বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই। এসব এলাকায় ছিনতাই ও টানা পার্টি ঠেকাতে হিমশিম অবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় দাপিয়ে বেড়ায় এমন সাত হাজার ছিনতাইকারী নাম-পরিচয় পুলিশের কাছে রয়েছে। তাদের মধ্যে কে কোন এলাকায় ছিনতাই করে, সেটাও উল্লেখ আছে। ছিনতাইকারীদের অনেকের নামে ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। ৫ থেকে ৯টি মামলা রয়েছে অর্ধেকের বেশি ছিনতাইকারীর নামে। এসব মামলায় অনেকের সাজা হয়েছে। তার পরও এমন অপরাধ রোধ করা যাচ্ছে না।

এদিকে ছিনতাই প্রতিরোধে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমপি। ক্রাইম বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় টহল দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো ছিনতাইকারীকে আটকের পর আগের মতো নতুন মামলায় কারাগারে চালান না দিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে সাজা দেওয়া হচ্ছে, যাতে নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা বন্দি থাকে। কোনো ছিনতাইকারী জামিন পাওয়ার পর যেন তথ্য জানতে পারে সংশ্লিষ্ট থানা সেই উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪১০টি। তবে ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনা এর কয়েক গুণ। এ সময়ে ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ৮২০টি। আর ছিনতাইয়ের সময় হাতেনাতে আটকের ঘটনা ৬৪৪টি। ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ অপরাধ ক্রমে বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে শতাধিক ছিনতাইর ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে শুধু ঢাকায় খুন হয়েছে ১০ জন।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইকারী চক্রের অধিকাংশ সদস্যই মাদকে আসক্ত। তারা সহজে টাকা পাওয়ার জন্য ছিনতাই করে। একবার কেউ সহজে টাকা পাওয়ার এ পথ পেলে জীবনে আর ছাড়ে না। তারা গ্রেপ্তার হলে বের হয়ে আবার একই ধরনের অপরাধে জড়ায়। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের নির্ধারিত আইনজীবী রয়েছে। তারাই জামিন করিয়ে দেন। পরে ছিনতাইকারী বের হয়ে আইনজীবীর টাকা পরিশোধ করে। এ ছাড়া আদালতও কিশোর অপরাধ বিবেচনায় জামিন দিয়ে দেন। এ সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির আইনজীবী।

ঢাকার বিমানবন্দর থানার ওসি ইয়াসিন আরাফাত খান বলেন, ‘বিমানবন্দর থানার গোলচত্বর ও আশপাশের এলাকায় আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক ছিনতাই ও টানা পার্টির সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের অধিকাংশকে মামলার রেকর্ড দেখে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, যাতে সহজে বের হতে না পারে।’

ছিনতাইকারীর হাতে নিহত
গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ অংশের ঢালে কামরুল হাসান নামে এক যুবক ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর মগবাজারে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে হাবিবুল্লাহ নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ওইদিন বড় মগবাজার এলাকায় মো. রাকিব (২৪) নামে এক গার্মেন্টের কর্মী ছুরিকাঘাতে খুন হন। ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ওয়াজেদ সীমান্ত খুন হন। সীমান্ত আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

এ ছাড়া গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালীতে রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মুস্তাকিম আলিফ নামের এক তরুণ। ১৬ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দিনমজুর আলমগীর বেপারি। ৩ সেপ্টেম্বর কদমতলীর মেরাজনগরে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে খুন করে কাঁচামাল বিক্রেতা হাশেমকে। একই দিন ভোরে হাজারীবাগের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক সাদেকিনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ২৭ আগস্ট ভোরে দারুস সালাম এলাকায় জাররাফ আহমেদ নামে এক যুবক ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ হারান।

ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীজুড়ে ছিনতাই প্রতিরোধে টহল বাড়ানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে একাধিক টিম কাজ করছে। এ ছাড়া ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় চিহ্নিত করে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

ছিনতাইকারীদের তথ্য বিশ্লেষণ
সম্প্রতি প্রায় এক হাজার ছিনতাইকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভাসমান ও উঠতি বয়সী তরুণরা বেশি জড়িয়ে পড়ছে এ অপরাধে। রাজধানীজুড়ে বেশ কয়েকটি ছিনতাই গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে বংশাল, তাঁতীবাজার ও ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছিনতাই চক্র নিয়ন্ত্রণ করে কোহিনুর বেগম মালা এবং কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি। চক্রের সদস্যরা ছিনতাই করা সামগ্রী তাদের কাছে জমা করে। জানা গেছে সিন্ডিকেটের ছত্রছায়া ছাড়া কেউ দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না। প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ এককভাবে ছিনতাই শুরু করলেও এক পর্যায়ে গ্রুপে যুক্ত হয়। গ্রুপে থাকলে জামিনের ক্ষেত্রে সুবিধা পায় তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *