রাজনৈতিক দলের ভিতরে সব চেয়ে জামায়াত ইসলামী দলের আয়ের উৎস বেশি ।

মোঃ আব্দুস সালাম:
ইচ্ছে করলে যে কোন ব্যক্তি যে, কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন ।দলের সাংগঠনিক কাঠামো মেনে চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলে। দল তাকে একটি সম্মান সূচক পদে বসিয়ে দেন । আবার এক দল থেকে অন্য দলে যোগদান করতে অনেক কেই দেখা যায় । অনেক সুবিধা ভোগী ব্যক্তি আছেন? যারা যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সে দলে যোগদান করে । শুধুমাত্র কেবল নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য । তারা প্রকৃতি পক্ষে কোন দলকে ভালবাসেন না বা দেশপ্রেমিকও নয় । এরা সুযোগ সন্ধানী লোক ।

প্রতিটি রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করলে সেখান থেকে কিছু হলেও অর্থ উপার্জন করা যায় । বা কিছু টাকা হলে নিজের পকেটে আসে । নিজের কাছ থেকে ব্যয় করতে হয় না ।
কিন্তু বাংলাদেশ জামাত ইসলামের একটি ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক দল । কেউ ইচ্ছা করলে সহজেই এই রাজনৈতিক দলের সংগঠনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না ।

এর জন্য তাকে কঠিন নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হয় । টাকা উপার্জন তো দুরের কথা প্রতি মাসে নিজের উপার্জন করা টাকা থেকে ৫% টাকা দল চালানোর জন্য সংগঠনে জমা দিতে হয় । এই নিয়মাবলী যদি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের থাকতো । তাহলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মর্যাদা আজ অনেক উপরে থাকতো ।

জামায়াত ইসলামী দলের টাকা আয়ের উৎস:
ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদ, আহতদের পাশে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। একই সাথে বন্যাদূর্গতদের মাঝে প্রথমদিন থেকেই সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। শুধু এবারই নয়, দেশের যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগেও তারা মানুষের পাশে পৌঁছে যায় সবার আগে।

আবার দলের কোন কর্মী বা ছেলে মিয়ে উচ্চ শিক্ষিত হলে চাকরি নিয়ে দেওয়া হয় । কেউ অসুস্থ হলে, চিকিৎসার সমর্থন যদি না থাকে ।তাহলে দল থেকে তাকে চিকিৎসা করানো হয় ।

এটা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, জামায়াতের এত বিপুল অর্থের উৎস কী? এই প্রশ্নটি আমিও করেছিলাম, এক জেলা আমীরের কাছে। সভাপতিকে এরা ইসলামী পরিভাষায় আমির বলে। তাদের একটি জেলা পর্যায়ে প্রোগ্রামে আমি অংশ গ্রহণ করেছিলাম।

প্রোগ্রাম শুরু হলো। তারা মাসে কে কতদিন কোরআন পড়েছেন, কোন কোন সূরার তাফসীর পড়েছেন, কয় টি ভাল কাজ করেছেন, কয়টা মিথ্যা কথা বলেছেন, কয় ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে , ইত্যাদি নোট করেছেন সেগুলো আমাকে জানালেন। হাদীস, সাহিত্য, পত্রিকা বিষয়েও একইভাবে বললেন। তাদের একটি রিপোর্ট বই দেখলাম। ডায়েরীর মতো। প্রতিদিনের হিসাব লেখা। ৩০ দিনের হিসাব যোগ করে বলছেন দেখলাম। কত ওয়াক্ত জামায়াতে নামাজ পড়েছেন, কয় ঘন্টা সাংগঠনিক কাজ করেছেন, কতজনকে নামাজ এবং ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, কতটি জানাজায় উপস্থিত হয়েছেন এসব একে একে সব পড়ে শোনালেন। একজনের রিপোর্ট পড়া শেষ হলে, অন্যরা মৃদু রিমান্ডে নিলেন তাকে। কেউ জিজ্ঞেস করলো, জামায়াতে নামাজ ছুটে গেছে ৫ ওয়াক্ত! কেন ছুটলো? কেউ বললো, মাত্র ৩০০ পৃষ্ঠা বই পড়েছেন এক মাসে! কেন?

এই প্রশ্নগুলো যাকে করা হলো, তিনি কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিচ্ছিলেন। অবশেষে তাকে সবাই মিলে পরামর্শ দিলেন, আপনাকে অমুক অমুক দিকে উন্নতি করতে হবে। এভাবে উপস্থিত প্রত্যেকে তাদের ব্যক্তিগত রিপোর্ট পেশ করলো এবং সবাইকেই জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হলো। কেউ মন খারাপ করলো না। বরং তাকে সমালোচনা করার জন্য সবাইকে তিনি কৃতজ্ঞতা জানালেন। আমি অভিভূত হচ্ছিলাম সেটা দেখে।

এবার ঘটলো মজার ঘটনা। একজন মুরুব্বি ২৩০ টাকা বের করে আমিরের পাশের লোকটিকে দিলেন। তিনি খাতায় লিখে নিচ্ছিলেন। আরেকজন দিলেন ৫০০/- কেউ দিলেন ৫০০০/-। সবার থেকে ওখানে ২০-২৫ টাকা কালেকশান হতে দেখলাম। আমি চুপচাপ দেখছিলাম।
আমির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কেন টাকা দিচ্ছে।

তিনি বললেন, “দল চালানোর জন্য। আপনারা যেটাকে চাঁদা বলেন, এটা অনেকটা সেরকম।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন প্রোগ্রাম আছে?”
তিনি বললেন, “প্রতিটা দিনই তো আমাদের প্রোগ্রাম। কোন বিশেষ জনসভা নয়। এটা আমাদের প্রতিদিনের কাজ।”

– তাহলে একেকজন একেক পরিমাণ টাকা দিলেন কেন?
– সবাই সমান টাকা দিয়েছেন।

আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “তা কেন হবে! আমি তো দেখলাম একজন ২৩০ টাকা দিলেন আবার একজন ৫০০০ টাকা দিলেন। ”

আমির সাহেব বললেন, ” সবাই তার আয়ের সমান দিয়েছেন। যিনি ২৩০ টাকা দিলেন উনি রিক্সা চালান। উনার এই মাসে যা আয় হয়েছে তার ৫% সংগঠনের ফান্ডে দিলেন। যিনি ৫০০০ টাকা দিলেন, উনি ব্যবসায়ী। উনার আয়ের ৫% উনি দিয়েছেন। আমাদের কাছে ঐ ২৩০ টাকা আর ৫০০০ টাকা দুটোই সমান।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যিনি ২৩০ টাকা দিলেন উনি তো খুব বয়স্ক মানুষ। এতো কম আয়। উনি তো রিক্সাও চালাতে পারেন বলে মনে হলো না। তাছাড়া এতো কম আয়ে উনার নিজেরই চলতে পারার কথা নয়!”

আমির সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো। বললেন, “ঐ চাচা কোন মাসে টাকা বাকি রাখেন না। কোনদিন তার অভাবের কথা বলেননা। প্রত্যেক প্রোগ্রামে সবার আগে টাকা জমা দেন।”

আমি আমার উত্তর পেয়ে গেলাম। তারপরও বললাম, “তাহলে আপনাদের উপজেলায় প্রতিমাসে এই ২৫-৩০ হাজার টাকা আয়?”

আমির সাহেব এবার হাসলেন। বললেন, “এটা শুধু সদস্যদের আয় দেখলেন৷ এরকম আমাদের সংগঠনের চারটি স্তর আছে। প্রথমে সমর্থক, এরপর কর্মী, তারপর অগ্রসর কর্মী। সবশেষে সদস্য। সমর্থক আর কর্মীরা ইচ্ছা মতো টাকা দেয়। অগ্রসর কর্মী আর সদস্যরা ৫% দেওয়া বাধ্যতামূলক। সেগুলো আমাদের বিভিন্ন ইউনিট কালেকশান করে আরেকটি প্রোগ্রামে পৌঁছে দিবে।”

আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, “এতো আয় হয়। হিসেবে ভুলভ্রান্তি হয় না?”

তিনি বললেন, “আমাদের আয় এবং ব্যয় হয় রিসিট ভাউচারের মাধ্যমে। বছরের বেশ কয়েকবার প্রতিটি ইউনিট, উপজেলা, জেলা, কেন্দ্র অডিট হয়। ভুল হওয়ার কোন সুযোগ নেই।”

শেষ প্রশ্ন করলাম, “এই টাকাগুলো আপনারা নিজেরা খরচ করেন?”

তিনি বললেন, “না। আমাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেন্দ্রে পাঠাতে হয়। আমাদের ইউনিট যেমন আমাদের কাছে দেয়, তেমনিভাবে আমরা জেলাকে পৌঁছে দিই। জেলা আবার একইভাবে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। এগুলোই কেন্দ্রের আয়।”

আমি মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করলাম। একটি জেলায় যদি এরকম আয় হয় তাহলে পুরো দেশে উনাদের লক্ষ লক্ষ সদস্যদের থেকে কত আয় হয়!

অন্য দলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেন্দ্র নীচের ইউনিটগুলোতে টাকা পাঠায় আর এরা উল্টো। নীচ থেকে এরা কেন্দ্রকে টাকা পাঠায়। কী অদ্ভূত ব্যাপার!