নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার পৌর এলাকার মাদারপুর এলাকার একটি খামারবাড়িতে বাজারের ব্যাগ থেকে ৮ কেজি ৪০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ। ফরিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির খামারবাড়ি থেকে জব্দ করা ওই হেরোইনের আনুমানিক মূল্য আট কোটি ৪০ লাখ টাকা বলে জানিয়েছিল পুলিশ। এই ফরিদুল এখনো ধোরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমনকি তার বিরুদ্ধে মামলাও করেনি পুলিশ। একাধিক সূত্র জানায়, এই ফরিদুল ইসলাম এখনো আড়ালে থেকে হেরোইনের বড় বড় চালান নিয়ন্ত্রণ করেন। মাদক কারবারিদের তালিকাতেও রয়েছে তার নাম। কিন্তু তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে চর বাগডাঙ্গা এলাকা থেকে ১০ কেজি হেরোইন জব্দ করে র্যাব-৫। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এটি রাজশাহী অঞ্চলে একদিনে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মাদক উদ্ধারের ঘটনা। ওই ঘটনায় শরিফুল ইসলাম ধুলু মিয়া ও তার ছেলে মোমিনুল ইসলামকেউ গ্রেপ্তার করা হয়। জামিনে বের হয়ে এসে এখনো শরিফুল ইসলাম ধুলু ও তার ছেলে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে হেরোইনের বড় বড় চালান পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
২০২৩ সালের ১২ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে অভিযান চালিয়ে ৬ কেজি ৭০০ গ্রাম হেরোইনসহ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আশিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সে এখনো মাদক কারবারে জড়িত।
সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিলি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাড়ে ছয় কেজি হেরোইনসহ তারেক হোসেন নামের এক মাদক কারবারীকে আটক করে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। জব্দকৃত হেরোইনের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা। ডিমভাঙ্গা মাদারপুর এলাকার এক সময়ে মুদি দোকানের কর্মচারি তারেক হোসেনে নিকট থেকে নগত ১৩ লাখ টাকা জব্দও করা হয়। এই তারেক জেলেখানায় বসে এখনো মাদকের নিয়ন্ত্রণ করছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই কয়জনই নন; রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনাববগঞ্চ ও নওগাঁ ও পাবনা জেলার অন্তত দুই শতাধিক মাদকের গডফাদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করেন মাদকের। এদের মধ্যে শুধু রাজশাহীর গোদাগাড়ীতেই রয়েছে ৭৭ জন পাইকারী হেরোইন ব্যবসায়ী ও গড ফাদার। যাদের প্রত্যেকজনই কোনো না কোনো রাজনীতিক দলের সঙ্গে জড়িত। তারা কেউ পেশায় রাজমিস্ত্রি, ঠিকাদার, গরুর খামারি, মাছচাষি, অটোরিকশা চালক, আমদানি কারক, সাংবাদিক, গরু ব্যবসায়ী, মুদি দোকানদার, ইটভাটার মালিক, ট্রাকের ব্যবসায়ী, আম বাগানের মালিকসহ নানা পেশার আড়ালে মূলত মাদক কারবারে জড়িত। যাদের অধিকাংশই একসময় কেউ দিনমজুর, কেউ ডিম বিক্রেতা, কেউ দোকানের কর্মচারী, কেউ গাড়ী চালক বা সুপাইরভাইজার, কেউ গরু ব্যবসায়ী ছিলেন। এদের বেশির ভাগকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন তানোর-গোদাগাড়ীর সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওমর ফারুক চৌধূরীর মালিকানাধীন রাজশাহী নগরীর নিউ মার্কেট এলাকায় গড়ে তোলা বহুতল মার্কেট থিম ওমর প্লাজায় গোদাগাড়ীর অন্তত ২০ জন মাদক কারবারির দোকান অথবা ফ্ল্যাট কেনা রয়েছে। সাবেক এমপি ফারুক চৌধুরি এসব মাদক কারাবরিদের আশ্রয় দিয়ে তাদের উচ্চমূল্যে দোকান বা ফ্ল্যাট কিনতে বাধ্য করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী রাজশাহী অঞ্চলে শীর্ষ পাইকারী মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা হলো অর্ধশতাধিক। আর গড ফাদারের সংখ্যা আরও প্রায় ৩০ জন। এরা মূলত সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদক কারবারির নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর মাঠপর্যায়ে রয়েছে আরও শতাধিক মাদক কারবারি। দেশের অস্থিতিশীল পেিরবেশে এই মাদদক কারবারিরা এখন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যারা ফলে এখন মাঝে মধ্যেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকায় কেজি কেজি (কোটি কোটি টাকা মূল্যের) হেরেইন জব্দ করা যাচ্ছে। আগে মাসে-ছয় মাসে বা বছরে দুই একদিন এমন খবর পাওয়া যেত। এখন হর হামেশায় এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, ‘আফিম এখন মায়ানামারে বেশি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের বর্ডার আছে। তাই মাদক ঢুকাও সহজ হয়েছে।’
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরীকৃত প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী দেখা যায়, মাদকের গডফাদারদের মধ্যে যাঁদের নাম রয়েছে তাদের অন্যতম হলেন, গোদাগাড়ীর গড়ের মাঠ এলাকার ঠিকাদার শীষ মোহাম্মদ, মাদারপুর এলাকার নওসাদ আলী, একই এলাকার বিদেশে পলাতক নজিবুর রহমান, মাটিকাটা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল রানা, চারঘাটের তাঁতারপুর এলাকার মাছচাষি মোক্তার আলী, রাজশাহীর বড়বনগ্রাম এলাকার গরুর খামারি জিয়ারুল হক, রাজশাহী শহরের একাধিক সাংবাদিকও আছেন এই তালিকায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপু, শিবগঞ্জের দৌলতপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাক, উপজেলা তাঁতীলীগের সভাপতি ও চারবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নূরুল ইসলাম, আরেক ইউপি সদস্য জুয়েল, নওগাঁ জেলার চকদেবপুর এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী আর্চনা, দক্ষিণ কোকিল গ্রামের চাল ব্যবসায়ী মতিবুল ইসলাম, নাটোরের বড়গাছা এলাকার ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম, পাবনার সাধুপাড়া এলাকার আব্দুর রহমান, আতাইকুলা এলাকার মনি প্রমুখ। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মাদক মামলা আছে।
অন্যদিকে পাইকারী মাদক কারবারিদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর আচুয়াভাট এলাকার আরিফুল হক, লিপিস্টিকপাড়া এলাকার ইটভাটা মালিক তোফাজ্জুল হোসেন, হেলালপুর এলাকার এক সাংবাদিক, মাটিকাটা এলাকার পল্ট্রি খামারি মেজবাউল, গড়ের মাঠ এলাকার আমদানি-রপ্তানী কারক মাসুদ রানা বাবু, ব্যবসায়ী সেতাবুর রহমান বাবু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আজমাতপুর মণ্ডলটোলা এলাকার কচিবাবু, বারঘোরিয়া এলাকার ব্যবসায়ী রিফাত আলী, উজিপুরের কামাল, নাটোরের বড়গাছা এলাকার ব্যবসায়ী তারেক, রেলস্টেশন এলাকার আয়াত আলী, নওগাঁর চাকরাইল দেওয়ানপাড়া এলাকার বেলাল হোসেন, পাবনার হাড়িবাড়া এলাকার সামসুল প্রামাণিক প্রমুখ। এদের বিরুদ্ধে মাদকের এক থেকে একাধিক মামলা রয়েছে। কেউ এক থেকে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। এখনো কেউ কেউ আছেন। কারাগারে থেকেই তারা মাদকের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মাদকের গডফাদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনো অনেকেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এদেও মধ্যে গোদাগাড়ীর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতের কোনো কোনো নেতা সম্পৃক্ত রয়েছেন। আবার কেউ কেউ মাদকের টাকায় রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়ে এখন জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। এরা মাদকের আড়ালে কেউ গরুর খামার, কেউ ঠিকাদারি, কেউ মাছচাষি হিসেবে আয়কর প্রদান করেন। আদৌ এদের মূল ব্যবসা হলো মাদক।
সূত্র মতে, ২০২৩ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১ দশমিক ১৯ কেজি হেরোইন, ২৭ হাজার ৩৬২ পিস ইয়াবা ও ৩২৯ পিস ফেনসিডিল জব্দ করে। ওই বছরে ৪০২ জনকে আসামি করে মামলা হয় ৩৬২ টি। ২০২৪ সালে ৯৫০ গ্রাম হেরোইন, ৫ হাজার ৯৯৫ পিস ইয়াবা ও ৮৩২পিস ফেনসিডিল জব্দ করে। ওই বছরে ৩৬৮ জনকে আসামি করে মামলা হয় ৩৩২ টি। এই দুই বছরে বিপুল পরিমাণ গাঁজা, চোলাই মদ, ট্যাপেন্ডডল ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন মাদকও জব্দ করা হয়। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯২ জনকে আসামি মাদক মামলা হয় ৯০টি। এ সময়ে তিন গ্রাম হেরোইন ৩৯০ পিস ইয়াবা ও ১১৪ কেজি গাঁজা জব্দ করা হয়।
রাজশাহী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, রাজশাহী বিভাগের বেশ কয়েকটি জেলা সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। সীমান্ত এলাকা অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত। সে কারণে ইয়াবা, হেরোইন ফেনসিডিল ও গাঁজা সীমান্ত পথ দিয়ে দেশে ঢুকে। আর মাদক ব্যবসা খুবই লাভজনক হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনেকেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। আমরা সেসব ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে মাদকের যে চাহিদা আছে, সেটি কমাতে যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই দেশে মাদককারবারির সংখ্যা কমবে।
জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে মাদক কারবারিদের সংখ্যা বেশি। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে মাদক ব্যবসা বেশি হয়। তবে আমাদের পুলিশ খুব সজাগ আছে। অনেকেই গ্রেপ্তার হচ্ছে। অনেককেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে। মাদক নিয়ে কোনো আপোষ নাই বললেন পুলিশ অফিসার